top of page

 

 

 

 

 

 

হাইকু তিন লাইনের জাপানি কবিতা।  প্রথম ও তৃতীয় লাইনে ৫টি আর মাঝের লাইনে ৭টি মোরা অর্থাৎ ৫-৭-৫ বিন্যাসে মোট ১৭টি মোরা থাকে।  মোরা জাপানি শব্দের একক যা ইংরাজীর সিলেবল অথবা আমাদের বাংলার অক্ষর বা মাত্রার অনুরূপ তবে একেবারে অভিন্ন নয়।  এই হাইকু লেখার রীতি জাপানে শুরু হয় প্রায় খ্রীষ্টিয় অষ্টম শতাব্দী থেকে যা পরবর্ত্তীকালে জাপানের জীবন, রীতিনীতি ও সংস্কৃতির এক বিশেষ অঙ্গ হয়ে ওঠে।  হাইকুকে তার সুদীর্ঘ ইতিহাসে লেখার পদ্ধতির বহু পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে আসতে হয়েছে।  ৫-৭-৫ মাত্রার বিন্যাস ছাড়াও হাইকুর বিশেষত্ব ঋতু বা প্রকৃতি বা সৌন্দর্য্য-ভিত্তিক শব্দের ব্যবহার ও গভীর ভাবের প্রকাশ।  প্রথাগত হাইকুতে ঋতু বা ঋতুবদলে প্রকৃতির রূপের প্রাধান্য থাকে।  সাধারণতঃ হাইকুতে দুটি চিত্র বা ভাবের পাশাপাশি অবস্থান থাকে।  এখানে কোন বর্ণনা বা বিশ্লেষণ থাকে না।  কবি তার পঞ্চ ইন্দ্রিয়তে যা দেখে বা ভাবে তাই ভাষার মাধ্যমে সংক্ষপে চিত্র আঁকে - মূল ভাবটা হচ্ছে চিত্রটা দেখাও - বর্ণনা করতে যেও না। চিত্র সম্পূর্ণ করার দায় পাঠকের।  হাইকু কবিতার কোনো শিরোনাম থাকে না।  হাইকু লিখিয়ে কবিদের বলা হয় হাইজিন।

 

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ জাপান ভ্রমণে এসে এই হাইকু কবিতাতে বেশ প্রভাবিত ও মুগ্ধ হয়েছিলেন।  তাঁর জাপান যাত্রী গ্রন্থে তিনি লিখেছেন – “জাপানি বাজে চেঁচামেচি ঝগড়াঝাঁটি করে নিজের বলক্ষয় করে না।  প্রাণশক্তির বাজে খরচ নেই বলে প্রয়োজনের সময় টানাটানি পড়ে না।  শরীর-মনের এই শান্তি ও সহিষ্ণুতা ওদের স্বজাতীয় এই যে নিজের প্রকাশকে অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত করতে থাকা, এ ওদের কবিতাতেও দেখা যায়। তিন লাইনের কাব্য জগতের আর কোথাও নেই।  এই তিন লাইনই ওদের কবি, পাঠক, উভয়ের পক্ষেই যথেষ্ট... এই কবিতাগুলির মধ্যে কেবল যে বাক্‌সংযম তা নয়, এর মধ্যে ভাবের সংযম।  এই ভাবের সংযমকে হৃদয়ের চাঞ্চল্য কোথাও ক্ষুব্ধ করছে না।  আমাদের মনে মানুষের একটা ইন্দ্রিয়শক্তিকে খর্ব করে আর-একটাকে বাড়ানো চলে, এ আমরা দেখেছি।  সৌন্দর্যবোধ এবং হৃদয়াবেগ, এ দুটোই হৃদয়বৃত্তি।  আবেগের বোধ এবং প্রকাশকে খর্ব করে সৌন্দর্যের বোধ এবং প্রকাশকে প্রভূত পরিমাণে বাড়িয়ে তোলা যেতে পারে–এখানে এসে অবধি এই কথাটা আমার মনে হয়েছে”।

 

রবীন্দ্রনাথের ‘লেখন’ ও ‘স্ফুলিঙ্গ’ এই দুইটি কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত কবিতাগুলো ছোট কবিতা – কিন্তু ঠিক আইন মাফিক হাইকু নয়।  এই কবিতাগুলো সম্বন্ধে কবি বলেছেন – “এই লেখনগুলি সুরু হয়েছিল চীনে জাপানে। পাখায় কাগজে রুমালে কিছু লিখে দেবার জন্যে লোকের অনুরোধে এর উৎপত্তি”।  অর্থাৎ এই কবিতাগুলি আসলে অটোগ্রাফ। কবি নিজেও কোথাও হাইকু বলে দাবী করেন নি যদিও সপ্তদশ শতকের বিখ্যাত হাইজিন মাৎসুও বাশোও-র বিখ্যাত

 

ফুরু ইকে ইয়া

কাওয়াজু তোবিকোমু

মিজু নো ওতো  

 

হাইকুটিকে – রবীন্দ্রনাথ এই কবিতাটি বাংলায় অনুবাদ করে এর বিশেষত্ব সম্বন্ধে লিখেছেন -

                “পুরোনো পুকুর,

                    জলের শব্দ,

                        ব্যাঙের লাফ”।

বাস!  আর দরকার নেই।  জাপানি পাঠকের মনটা চোখে ভরা।  পুরোনো পুকুর মানুষের পরিত্যক্ত, নিস্তব্ধ, অন্ধকার।  তার মধ্যে একটা ব্যাঙ লাফিয়ে পড়তেই শব্দ শোনা গেল।  শোনা গেল – এতে বোঝা যাবে পুকুরটা কী রকম স্তব্ধ।  এই পুরোনো পুকুরের ছবিটা কী ভাবে মনের মধ্যে এঁকে নিতে হবে সেইটুকু কেবল কবি ইশারা করে দিলে; তার বেশি একেবারে অনাবশ্যক”।

 

হাইকু কবিতা সারা বিশ্বে জনপ্রিয়তা লাভ করে।  ইংরেজী, ফরাসি ও অন্যান্য ভাষাতেও হাইকু লেখার প্রচেষ্টা অনেকদিন আগে থেকেই চলে আসছে।  প্রখ্যাত আমেরিকান কবি এজরা পাউন্ড এই হাইকু কবিতার দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে কাব্যে ইমেজিসম বা চিত্রকল্পবাদ আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।  জাপানি ছাড়া অন্যান্য ভাষায় প্রথাগত হাইকু লেখা অসম্ভব না হলেও দুরূহ। কারণ প্রত্যেক ভাষার কবিতার নিজস্ব ছন্দ ও মাত্রা আছে।  এক ভাষার কোন বিশেষ ছন্দ বা মাত্রার কবিতা ভাব অক্ষুণ্ণ রেখে অন্য ভাষায় হুবহু অনুবাদ করা বা রচনা করা একপ্রকার দুঃসাধ্য।  যেমন আমাদের পয়ার ছন্দকে কি হুবহু অনবাদ করা চলে – ছন্দ মাত্রা এক রেখে?  তাই অন্যান্য ভাষায় বিশুদ্ধ হাইকুর সংখ্যা খুবই কম।

 

রবীন্দ্রনাথের ‘লেখন’ ও ‘স্ফুলিঙ্গ’ কাব্যগন্থের কয়েকটি কবিতা হাইকুর মতন তিন লাইনের কিন্তু প্রথাগতভাবে বিশুদ্ধ হাইকু নয় অর্থাৎ ৫-৭-৫ মাত্রার নয় এবং প্রকৃতির ছোঁয়া দু-একটা বাদ দিলে অধিকাংশতে অনুপস্থিত।  বেশ কয়েকটি কবিতায় প্রথম ও তৃতীয় লাইনে অন্ত্যমিল আছে আর আছে ছবির বদলে এক মহান দর্শন যা কবিতা পাঠের পরে হৃদয়ে সৃষ্টি করে নিঃশব্দ অনুরণন।  যেমন –

আলো যবে ভালবেসে

মালা দেয় আঁধারের গলে

সৃষ্টি তারে বলে ।।

 

অথবা,

 

আমার প্রেম রবি-কিরন-হেন

জ্যোতির্ময় মুক্তি দিয়ে

তোমারে ঘেরে যেন।।

 

প্রথাগত বিশুদ্ধ হাইকু থেকে ভিন্ন মাত্রার ও ভাবের এই জাতীয় কবিতাকে অনেকে মুক্তক হাইকু বা উন্মুক্ত হাইকু বলে থাকেন – বিশেষতঃ আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশে এ নিয়ে যথেষ্ট চর্চ্চা হয়ে থাকে।  কিছু উন্মুক্ত হাইকু লেখার প্রচেষ্টা হয়েছে। তবে এ ক্ষেত্রে প্রথাগত হাইকুর রীতিনীতির থেকে রবীন্দ্রনাথের তিন লাইনের অন্ত্যমিলযুক্ত অনুকবিতাগুলো আমাকে বেশী অনুপ্রাণিত করেছে।

উন্মুক্ত হাইকু

(Haiku)

(১)

বসন্তের হাওয়ায়

কোথাও ফোটে ফুল

কোথাও বা ঝরে পাতা।

 

(২)

নিদাঘের নিস্তব্ধ দুপুর,

দাঁড়কাকের ডাক

নির্জনতার নির্মম প্রকাশ।

 

(৩)

ফুটলো ফুল

এল মধুর লোভে

অলির কুল।

 

(৪)

সুপ্ত যা সব থাকে,

ঘুমের মাঝে উঠলে জেগে

স্বপ্ন বলে তাকে।

 

(৫)

স্বপ্নগুলো ভাঙা,

জীবনপুরের সাঁঝবেলাটা

অস্তরাগে রাঙা।

(৬)

স্বপ্ন ভরা মন,

বাস্তবেরই কষাঘাতে

হারিয়ে গেছে কখন।

 

(৭)

গভীর ঘুমের দেশে,

স্বপ্নগুলো মিলিয়ে গেছে

কোথায় ভেসে ভেসে।

 

(৮)

পাতার ফাঁকে ফাঁকে

নেচে নেচে টুনটুনিটা

টুইট টুইট ডাকে।

 

(৯)

শীতের সকাল বেলা,

মিঠে রোদের নরম আলোয়

প্রজাপতির মেলা।

 

(১০)

পাতার ভেলা জলে,

নদীর স্রোতে ভেসে ভেসে

দূর দেশে যায় চলে।

 

(১১)

কাশ ফুটেছে মাঠ ভরাতে,

আগমনীর সুর বাজে ঐ

বৈরাগীদের একতারাতে।

 

(১২)

ফুলের কানে কানে,

ভ্রমর এসে গুনগুনিয়ে

মাতিয়ে দিল গানে।

 

 

(১৩)

বাগানের আশপাশে,

প্রজাপতি ওড়ে যখন

ফুলগুলো সব হাসে।

 

(১৪)

বাতাস বয়ে চলে,

নদীর সাথে গোপন কথা

ঢেউয়ের তালে তালে।

 

(১৫)

পদ্মপাতায় জল,

ঝিকিমিকি রোদ্দুরেতে

করছে টলটল।

 

(১৬)

জীবনস্মৃতি সুখের,

দিনগুলো যে চলে গেল

এটাই বড় দুখের।

 

(১৭)

জীবন নদীর জলে,

দুঃখ-সুখের স্মৃতিগুলো

আপনি ভেসে চলে।

 

(১৮)

তাকিয়ে আকাশ পানে,

মনটা আমার ভেসে চলে

অনন্তের আহ্বানে।

 

(১৯)

অনন্ত আকাশে,

বিভাসেরা ডানা মেলে

আনন্দেতে ভাসে।

 

(২০)

আঁধার রাতের আকাশ,

লক্ষ তারার আল্পনাতে

বিশ্বদেবের প্রকাশ।

 

(২১)

ঘটের মাঝে নামী,

ঘটটি ফেটে চৌচির হ’ল

বেরিয়ে এলেম আমি।

 

(২২)

সর্ব্বশক্তি বিভু,

হৃদয় মাঝে লুকিয়ে আছ

তোমায় দেখি নি কভু।

(২৩)

যা কিছু সব সান্ত,

তাদের মাঝেই প্রকাশিত

অখন্ড অনন্ত।

 

(২৪)

শোন বলি মন তোরে,

চেষ্টা করলে খুঁজে পাবি

সোনার বুদ্ধ অন্তরে।

 

(২৫)

আছ তুমি অন্তরে,

তবুও তোমায় খুঁজে বেড়াই

দূরে দূরান্তরে।

bottom of page